রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের সার্থকতা
রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে ঘরে বাইরে সার্থকতা
‘ঘরে বাইরে’
রচিত হয় ‘গোরা’ উপন্যাসের
পরে। ‘গোরা’ উপন্যাসে আমরা লক্ষ্য
করেছি সমাজের অখণ্ড রূপ। নবজাগরণের প্রভাব, স্বাদেশিকতা;
প্রাচীন আচারের বিরুদ্ধে নবআন্দোলন, ব্রাহ্মসমাজ
এবং হিন্দুদের বিরোধ এখানে অঙ্কিত হয়েছে। ‘গোরা’ রবীন্দ্র ভারত চেতনার প্রকাশিত রূপ।
‘ঘরে বাইরে’
উপন্যাসে ব্যক্তিত্বের মধ্যে সংঘর্ষকে আঁকতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
নায়িকা বিমলার মধ্যে সংঘর্ষ চূড়ান্ত। যা ব্যক্তি সংযাত। রবীন্দ্র ব্যাখ্যায় —
“বিমলার Struggle নিজেরই প্রেয়ের সঙ্গে
শ্রেয়ের, সন্দীপ নিজের মধ্যে নিজেরই হারজিৎ বিচার করছে—নিখিলেশও নিজের felling-এর সঙ্গে নিজের কর্তব্যের adjustment
করছে। অন্য কোনো মানুষ বা ঘটনা সম্বন্ধে এরা সাক্ষ্য দিচ্ছে না।
এদের আত্মানুভূতি নিজের record নিজে রাখছে।” রাজনীতির পটভূমিতে ‘ঘরে বাইরে’ লেখা হলেও এখানে রাজনীতি সেভাবে প্রাধান্য পায়নি। শুধু কয়েকটি ক্ষেত্রে
রবীন্দ্র মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে এই উপন্যাসের পটভূমিতে রাখা
হয়েছে। সন্দীপের চরিত্র সৃজনে সেই সময়ের ভব্য রাজনৈতিক নেতাদের ছাপও কিছু
পড়েছে। কিন্তু রাজনীতি সম্বন্ধে কোন প্রত্যক্ষ কথা এই উপন্যাসে নেই।
‘ঘরে বাইরে’
উপন্যাসের মূল সত্য হল “সত্য প্রেমের পথ
আরামের পথ নয়, সে পথ দুর্গম। সিদ্ধিলাভ সকলের শক্তিতে নেই
এবং সকলের ভাগ্যেও ফলে না। কিন্তু দেশের প্রেমে যদি দুঃখ ও অপমান সহ্য করি,
তাহলে মনে এই সান্ত্বনা থাকবে যে, কাঁটা
বাঁচিয়ে চলবার ভয়ে সাধনায় মিথ্যাচরণ করিনি।” নিখিলেশের
মুখের এই কথা আসলে স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথেরই কথা। ‘ঘরে বাইরে’-তে
কিছু রাজনৈতিক ভাবনার ইঙ্গিত বর্তমান। ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে উপন্যাসটি লেখা হয়। তখন
দেশে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রেশ চলছে। কলকাতার জনজীবনে রাজনৈতিক চিন্তা, অস্থিরতা, অবিলতা বর্তমান। রবীন্দ্রনাথ সে বিষয়ে
নিজের মত দিয়েছেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলার রাজনীতিকে
বিক্ষুব্ধ করেছিল। উন্মাদনা বাংলার সুস্থ জীবন ও বোধকে আবিল করেছিল। সে প্রসঙ্গে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতকে ‘ঘরে বাইরে’-তে
এনেছেন। বিমলার কথার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একটা কথাকে পরিষ্কার করে বলতে চেয়েছেন যে
দেশের নামে যারা ত্যাগ করে তারা সাধক। দেশের নামে যারা উপদ্রব করে তারা শত্রু।
স্বাধীনতার গোড়া কেটে তারা আগায় জল দেয় ৷
রাজনৈতিক আবর্তে
কিছু দেশনেতা নিজের প্রচারে মগ্ন হয়েছিল। স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠতে তারা পারেনি।
নীতিজ্ঞানহীনতার পরিচয় রেখেছিল। স্বদেশী লড়াইয়ের সুযোগে ভণ্ড সেই নেতারা
দেশপ্রেমিকের আবেগে কুমিরের চোখের জল ফেলতো । তাদের কথায় ছিল চটক। তারা
অন্তঃসারশূন্য প্রতারকের প্রতীক। সন্দীপ এই উপন্যাসে তেমনই একটি চরিত্র।
আবার তেমন
দেশপ্রেমিকও তখন ছিলেন যাদের দেশপ্রেমের মধ্যে কোন গলদ ছিল না। তারা আদর্শবাদী
ছিলেন। নিষ্ঠাবান ছিলেন। দেশের জন্য ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন ৷ বন্দেমাতরম ছিল
তাঁদের মন্ত্র। এদের মধ্যে কেউ ক্ষমতালোলুপ থাকলেও তারা সন্দীপের মতো ছিলেন না।
সন্দীপ বহু নারীর সর্বনাশ করেছিল। নিখিলেশের উদারতার সুযোগে বিমলাকে নিয়ে মজা
লুটতে চেয়েছিল। আসলে সন্দীপের মধ্যের এই গুণগুলি অনেকটা যেন আরোপিত ।
রবীন্দ্রনাথ
সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে ভালো ভাবনা কোনসময় ভাবেননি। এমনকি স্বদেশি বিপ্লবীদেরও তিনি
শ্রদ্ধা করতে পারেননি। সন্দীপের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সত্যের প্রত্যয় করবেন—এবিষয়ে সেইসময়ের পাঠকেরা সেভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ‘ঘরে বাইরে’ প্রকাশের পরে তাঁকে কিছুটা প্রতিকূল
সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। দেশময় বিক্ষোভ বাঁধে রবীন্দ্রনাথের কাছে দেশপ্রেমিকরা
হেয় হয়েছেন বলে। রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজপত্র’-তে ‘প্রবাসী’-তে নিজের পক্ষের
কথা বলেন। তিনি বলেছেন ‘ঘরে বাইরে’-কে
যেন উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়। পাঠকের চোখে উপন্যাসের ভেতর তবু ও একটা চিন্তা
ফুটে ওঠে । দেশের দরিদ্র মানুষকে বাঁচানো আগে প্রয়োজন। দেশ বলতে দেশের মানুষকে
আগে বুঝতে হবে। দেশের মানুষকে খেপিয়ে তুললে দেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হবে না।
দেশের মানুষকে আত্মগঠনের মধ্য দিয়ে হতে হবে শৃঙ্খলাপরায়ণ। দেশীয় জিনিস সবাইকে
জোগান না দিয়ে সস্তা বিলিতি জিনিস বর্জন করা শ্রেয় নয়। ‘ঘরে
বাইরে’-র নিখিলেশ ও চন্দ্রনাথবাবুর মধ্য দিয়ে এই কথা প্রকাশ
করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
ফলে যাঁরা মনে করেন
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে রাজনৈতিক চিন্তার প্রকাশ করেছেন
তাদের কথাকে পূর্ণ মিথ্যা বলা যায় না। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের পটভূমিতে আছে বঙ্গ ভঙ্গ-র সময়ের আন্দোলন । বাংলায় যে রাজনৈতিক
উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল সে সুযোগে দেশে শুরু হয় উপদ্রব। তার রূপটিকেই এই উপন্যাসে
তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। স্বদেশি আন্দোলনের স্বরূপ কিছুটা হলেও তাই ‘ঘরে বাইরে’-তে আছে।
বিশ শতকের প্রথম
দিকে জাতীয় উন্মাদনার উন্মত্ততা কীভাবে দেশের মানুষের স্থির বুদ্ধিকে বিপথে চালিত
করেছিল,
সত্যকে সঙ্গে নিয়ে দেশের মানুষকে পথ দেখাবার চেষ্টা না করে স্থির
দৃষ্টিকে ঘোলা করার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে বাইরে’-তে দেশের মানুষকে যেন সজাগ করতে চেয়েছেন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের
সাথে আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ একসময় যুক্ত ছিলেন। সেই কারণে তিনি এই আন্দোলনকে
কাছের থেকে দেখেছেন। দেখেছেন তার ত্রুটিকে, তার
দুর্বলতাকে। তাই সমালোচনা করতে তিনি দ্বিধা করেননি।
দেশপ্রেমের নাম করে
দেশের মানুষ যে আমাদের ধর্মকে ত্যাগ করে একটা ফ্যাসানের বশবর্তী হয়ে পড়বে—রবীন্দ্রনাথ তা চায়নি। রাজনীতির ঘোলাজল অন্তঃপুরবাসিনী মেয়েদের পথে
নামালে তার সুফল ফলে না। এই উপন্যাসে সে কথা বলতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বিলিতি
জিনিস বয়কটই যে দেশসেবার একমাত্র নিদর্শন—এ মত রবীন্দ্রনাথ
মানতেন না। বিষয়টি যে মতলববাজ রাজনীতিকদের জিনিস তার পরিচয় এই উপন্যাসে
রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন। গরীব মানুষ দেশীয় জিনিস কিনতে পারছে না, সস্তাতে যে বিলাতি জিনিস পাওয়া যায় তা কিনতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কাজটি
সঠিক কিনা সে প্রশ্ন তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। দরিদ্রকে কাপড় জোগান দেওয়ার ক্ষমতা
নেই, অথচ তাদের ব্যবসার বিলেতি কাপড় পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই যুক্তি রবীন্দ্রনাথ মানতে চাননি।
তবু আমাদের মনে হয়
স্বদেশি আন্দোলনের পরিচয়কেই তুলে ধরতে রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে’
রচনা করতে চাননি। তিনি উপন্যাসই লিখেছেন। তিনি নিজে একথা বলেছেন।
কিন্তু উপন্যাসে এই যুক্তিকে উপস্থাপিত করেননি।
রক্তময় পথে বিপ্লব
আসুক এ রবীন্দ্রনাথ চাননি। ‘ঘরে বাইরে’-তে সন্দীপের চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মত এবং উদ্দেশ্যের বিষয়
পাঠককে জানাতে পারেন, কিন্তু মেনে নিতে পারেন কি? মনে হয় না। চন্দ্রনাথবাবু মাস্টারমশাই এবং নিখিলেশের মতো— রবীন্দ্রনাথের মত। তাদের উক্তিতে এই মত প্রচারিত হয়েছে, ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তাঁদের মত উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিপ্লববাদকে
নস্যাৎ করার জন্য সন্দীপের মতন প্রতারক চরিত্র সৃষ্টির বিষয়টি মনে হয়
রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের সম্পর্কে অসহিষ্ণু হয়েছিলেন। ভণ্ড সন্দীপকে বিমলা ভক্তি
করেছে—ভণ্ড দেশপ্রেমিককে গৃহ নারীর শ্রদ্ধার মধ্যে
রবীন্দ্রনাথ যেন প্রচ্ছন্নভাবে একটা ব্যঙ্গকে আঁকতে চেয়েছেন। সন্দীপের ভেতর দিয়ে
যে দেশনায়কের ছবিকে রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন, সেই স্বার্থপর
মানুষটি বিপ্লবীদের প্রতি সুবিচারতো দূরে থাক, তা একটা
অন্যায় প্যারোডি রচনা করেছে। সেই স্বদেশি যুগে যে আত্মত্যাগবিসর্জনকারী মানুষেরা ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র উচ্চারণ করে ভয়হীন ভাবে ফাঁসির
দড়ি গলায় নিয়েছেন—তারা অপরিচিত ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ যদি
সন্দীপের ভেতর দিয়ে তাদের কথা দেখতে পেয়ে থাকেন, তবে তা
দেশের পক্ষে সৌভাগ্য নয়। মতের অমিল থাকতেই পারে। কিন্তু তার জন্য বিরুদ্ধ মতকে
ছোটো করার জন্য হরিশ কুণ্ডুর মতো জমিদারকে দেশসেবি রূপে আঁকা রবীন্দ্রনাথের কাছ
থেকে প্রত্যাশিত নয়। আমাদের মনে হয় এতে উপন্যাসের শিল্প সৌন্দর্যের হানি ঘটেছে।
সন্দীপ শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক টাইপ চরিত্র হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাতিত্ব
এখানে স্পষ্ট।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে
রবীন্দ্রনাথ নিজে জড়িত ছিলেন। দেশকে স্বাধীনের জন্য এই আন্দোলনের ভেতর
রবীন্দ্রনাথ হয়তো অন্তসারশূন্যতা দেখে থাকবেন। ফলে তিনি ধর্মকে বিকিয়ে দেশকে
বড়ো করে তোলার পাশ্চাত্য শিক্ষার সমালোচক ছিলেন। চন্দ্রনাথবাবুর মুখে আমরা শুনি—“বিদেশ থেকে একী পাপের মহামারী আমাদের দেশে প্রবেশ করল।” রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসকে নিছক একটি উপন্যাসই বলেছেন। রাজনীতির কোনো কথা
এখানে এলে তা প্রাসঙ্গিক, মূল কাহিনির অঙ্গীভূত নয়। প্রেম
নিয়ে নিখিলেশের একটি বিশ্বাস এবং তাকে নিয়ে পরীক্ষাই ‘ঘরে
বাইরে’ তে স্থান পেয়েছে। নিখিলেশ স্ত্রীকে ঘরে না রেখে
বাইরের জগতে মুক্তির মধ্যে বিকশিত করার সুযোগ দিয়েছে। এও ঠিক স্বামীকে যদি স্ত্রী
ভালোবাসে তবেই তা পাওয়া যায়
‘ঘরে বাইরে’-তে নিখিলেশের বিপরীতে আঁকা হয়েছে সন্দীপকে । বিমলা তার স্বামীর প্রতিপক্ষ
হিসেবে যাকে দেখেছে সে প্রতারক। যদি সমান প্রতিপক্ষ হতো—তবে
বোঝা যেতো নিখিলেশের পরীক্ষা সফল হতে পারে। বিচারে পক্ষপাতিত্ব ঠিক নয়। একদিকে
বিরাট করে দেখানো, অন্যদিকে শূন্য। সমতা আসা সম্ভব কি?
নিখিলেশের মতো যদি বিমলা উদার আর এক পুরুষের সামনাসামনি দাঁড়াতো,
সেই সময় নিখিলেশের পরীক্ষা সার্থক হত ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন

